সেই বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবিদের দেশ, সেই ফিলিস্তিনের অংশ বিশেষ রাফাহ। একটা সময়ের কথা, আমার কি খুব ইচ্ছে করত ওখানে একটা সপ্তাহ কাটানোর। কল্পনা করতাম রাফাহর বালুকাময় সৈকত, মরুভূমির বুকে অসংখ্য খেজুর গাছ আর শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী মানুষগুলোর অবর্ণনীয় চেহারা নিয়ে। কিন্তু সে ইচ্ছা কখনোই পূরণ হয়নি।
যদিও রাফাহ কখনোই আমার হাতের নাগালে আসেনি, তবুও আমার মন একটা জায়গায় রাফাহর সঙ্গে অটুটভাবে জড়িয়ে গেছে। সে একটা মেয়ের নাম, রাফাহ। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু রাফাহ। আমার জীবনে এমন একজন মানুষ, যার একটা কথা আমাকে পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ করে দিতে পারে। অন্যদিকে, একটা কথা আমাকে গভীর বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দিতে পারে।
আমার জীবনে রাফাহর প্রথম আগমনটা হয়েছিল ঠিক একটা দশক আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল পরীক্ষা শেষের দিনটা ছিল সেদিন। পরীক্ষা ভালো হয়েছে, এমনটা কখনো মনে হয়নি। ফলে মুখে কোনো হাসি ছিল না। আবরু রক্ষার জন্যে হলেও লাইব্রেরিতে বসে প্রায় দুই ঘন্টা সময় কাটিয়ে দিলাম। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে আমার সামনের চেয়ারে বসল। আকাশী রঙের একটা ফ্রক পরেছিল সে। চুলটা মেঝে ছুঁই ছুঁই। চেহারায় একটা মিষ্টি হাসি। সে আমাকে বলল, "আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।" আমিও বলিলাম, "ওয়াআলাইকুম আসসালাম।" তারপর তার ইংরেজি বইটা আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, "ভাইয়া, একটু সাহায্য করবেন?"
আমার জীবনে ফিরে তাকালে সবথেকে বেশি যে সিদ্ধান্ত গুলোর জন্যে অসংখ্য বার ধন্যবাদ জানিয়েছি, সেই সিদ্ধান্তের একটি সেদিন রাফাহকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত। কারণ সেই একটা সাহায্য আমাকে বর্তমানের এই জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। আমাদের দুজনের মধ্যে সেদিন চিনামতার কথা শুরু হয়, যা পরবর্তীতে ভালোলাগার চরিত্র ধারণ করা শুরু করে। প্রেমের কিছুটা কাছাকাছি। বলে রাখা ভালো, কখনোই আমি রাফাহকে প্রপোজ করিনি। সেও আমাকে করেনি। কিন্তু আমরা দুজনেই জানতাম, আমাদের মধ্যে যে ভালোলাগা কাজ করছে, সেটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
রাফাহ আমায় একবার বলেছিল, "তুমি যদি প্রপোজ কর, আমি রাজি হব তাতে।" কথাটা কেমন যেন একটু অদ্ভুত মনে হয়েছিল আমার। প্রপোজ করারটা তো ছেলের কাজ হওয়ার কথা। মেয়ের এমনটা বলাটা আমার মনে ঠিক বসছিল না। ফলে প্রপোজ করলাম না। কিন্তু মনের ভেতরটা ছটফট করত।
আমাদের বন্ধুত্ব ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। সে আমার সবকিছু জানত, আমি তার সবকিছু জানতাম। একদিন সে আমাকে বলল, "তুমি প্রপোজ না করার ফলে আমিও তোমাকে প্রপোজ করতে পারছি না!" আমি হেসে জবাব দিলাম, "ঠিক আছে, তুমি প্রপোজ কর, আমি রাজি আছি।" সেও হাসল, বলল, "আমার ছেলেদের আবার আগে এগিয়ে আসতে হয় মেয়েদের কাছে। তুমিই আগে প্রপোজ করবা!" আমি প্রপোজ করলাম না। রাফাহও করল না। তবে আমাদের বন্ধুত্ব আরো গভীরতর হতে লাগল।
যদিও প্রেমের মতো গভীর একটা অনুভূতি আমাদের মধ্যে উঠে এসেছিল, কখনোই আমরা তাকে বেশি দূর সরতে দিইনি। একবার রাফাহর বাবা আমাকে আড়ালে বসিয়ে বলেছিলেন, "তোমাদের দুজনের মধ্যে একটা ভালো জুটি হতে পারে।" আমি খুশী হয়েছিলাম খুব। ভেবেছিলাম, এবার হয়তো আমাদের বিয়ে হবে। কিন্তু হয়নি। রাফাহ আমাকে জানাল, তার বাবা-মা তাকে বলেছে তার বয়স এখনো বিয়ের জন্যে উপযুক্ত নয়। আমি কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু বুঝেছিলাম, এটা তার মা-বাবার সিদ্ধান্ত, সেখানে আমার কিছু বলার নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হওয়ার পর আমি বিদেশে চলে গেলাম পড়াশোনা করার জন্যে। রাফাহর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। প্রতিদিন মেসেজ, সপ্তাহে একটা করে ফোন কল। মাঝে মাঝে ভিডিও কলও করতাম। বিদেশে থাকতে থাকতে আমার মনে হতো হয়তো এখনো আমাদের বিয়ে হওয়ার সময় আসেনি। হয়তো ফিরে যাওয়ার পর বিয়ের কথা বলতে পারব।
কিন্তু দুর্ভাগ্য! ফিরে আসার পর শুনলাম রাফাহর বিয়ে হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা ঝড়ো বাতাসের মতো এসে আমার জীবনটাকে উল্টে দিয়েছিল সেই খবর। তারপর আর কখনো তার খোঁজ খবর রাখিনি। এখন আমারও বিয়ে হয়ে গেছে। সুখে আছি। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে পড়ে রাফাহর কথা। কী করছে সে, কেমন আছে, কার সঙ্গে তার সংসার? আমার সঙ্গে থাকলে হয়তো আমাদেরও একটা সুখী সংসার হতো। তবে হয়তো হওয়ার ছিল না।
আমার রাফাহ, সেই যে একদিন ফ্রক পরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সাহায্য চেয়ে, সেই রাফাহর সঙ্গে আম