আয়ান্না পাত্রুডু




আমি কলকাতায় বড় হয়েছি, নিউমার্কেটের কাছাকাছি একটা বাড়িতে। ক্লাস ফাইভে আমাদের বাড়ির একটা বাসিন্দা এলেন আমাদের ফ্ল্যাটে আর বললেন, "একটা ছেলে ভয়ঙ্কর গান গায়।" আমরা তাঁর সঙ্গে নিচে গেলাম। সামনের বাড়ির একটা জানলায় একটা ছেলে ঘাড় গুঁজে বসে গিটার বাজাচ্ছে। সেটা ছিল আয়ান্না পাত্রুডু।
সেদিন থেকেই শুরু আমাদের প্রায় বারো বছরের গভীর বন্ধুত্বের। আয়ান্না ছিল একটা দারুণ স্বভাবের ছেলে। খুবই বন্ধুবৎসল। কিন্তু গান গাইলে সে যেন বদলে যেত। সে যখন গান গাইত, মনে হত ওর গলা থেকে যেন সামান্য একটা বিদ্যুৎ বেরোচ্ছে, আর সেই বিদ্যুৎ আমাদের শরীরের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে গিয়ে গভীরে কোথাও স্পর্শ করছে।
আয়ান্নার সঙ্গে আমাদের কত গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে—বলি আর কী! বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানি আয়ান্নাকে নিয়মিত অফার দিত, কিন্তু সে কোনোটাতেই রাজি হত না। তার একটাই শর্ত, গান নিজের মনের মতো হতে হবে। যদিও ওর গানের কোনো আলাদা স্টাইল ছিল না। যে গানের সাধ ওর মনে জাগত, সেই রকম গানই লিখত।
একটা ঘটনার কথা বলি। কলকাতায় ওদের প্রযোজনার একটা রেকর্ডিং কম্পানির সঙ্গে চুক্তি ছিল। আমরা রেকর্ডিং করতে গেলাম। রেকর্ডিংটা খুব বেশি ভালো খারাপ কিছুই ছিল না। কিন্তু কোম্পানির মালিককে ওর গানটা পছন্দ হল না। আমার সামনেই ওর সামনেই সে বলল, "না, এটা চলবে না।"
আয়ান्না সেদিন দুপুরেই ট্রেনে চলে এল। তার ব্যবহারে কোনো রাগ বা অনুযোগের ভাব ছিল না। বলল, "কিছু হয়নি। যা ভাগ্যে আছে, তাই হবে।"
ওর এই সহজ সরল ব্যবহারটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করত। গানটা চলল না, সে ক্ষতি হজম করে ফেলল। তার জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সে কখনোই হতাশ হয়নি। তার মনের ভিত্তিটা ছিল খুবই শক্ত। ওর মনে কখনোই কোনো অহংকারের বাঁধ ছিল না। তার মনটা ছিল সব সময়ই উন্মুক্ত।
আমার কাছে আয়ান্না অনেক বেশি ভালো বন্ধু ছিলেন পিয়ানোবাদকের চেয়ে। গানের চেয়ে, তার মানুষ হিসাবেই আমাকে ভালো লেগেছে সব চেয়ে বেশি।