গুরুচরণ সিং




গুরুচরণ সিং নামটি শুনলেই আমার মনে হাজির হয় এক দীর্ঘায়ত মুখের, অপরূপ সুশ্রী চেহারার এক মানুষের প্রতিচ্ছবি। এই গুরুচরণ সিংই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক। সাহিত্যে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা বিশাল ও অসামান্য। বাঙালি সমাজের মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থাকে এত সুন্দর করে তুলে ধরেছেন অন্য কোনো সাহিত্যিক তা এখনও দেখা যায়নি।

গুরুচরণ সিং ১৮৮৩ সালের ১ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর পৈতৃক নিবাস পাবনায়। তাঁর পিতার নাম সরবজিত সিং এবং মাতার নাম সরুপ কুঁয়রী। গুরুচরণ সিং তাঁর পিতামাতার প্রথম সন্তান হওয়ায় তাঁরা গোটা পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় তাঁর জন্ম হলেও তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পাবনায়। সর্বশেষ কলকাতায় এসে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। সেকালের অনেক শিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরাই তাঁর সহপাঠী ছিলেন।

গুরুচরণ সিং ছিলেন একজন অসাধারণ ছাত্র। তিনি অল্প বয়স থেকেই লেখালেখির প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি একটি ছোটগল্প লেখেন। এছাড়া তিনি কবিতাও লিখতেন। ছাত্রজীবনে তিনি ক্রিকেট, ফুটবল সহ বিভিন্ন ক্রীড়াকলাপে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। তিনি একজন দক্ষ অশ্বারোহী ছিলেন।

স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর গুরুচরণ সিং ১৯০৪ সালে লন্ডনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য যান। সেখানে তিনি 'ব্যাংক টাউন' নামে পরিচিত একটি ছাত্রাবাসে থাকতেন। তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। ১৯০৮ সালে তিনি লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে আসেন।

দেশে ফিরে আসার পর গুরুচরণ সিং আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি কিছুদিন বেহালায় কাজ করেন। পরে তিনি কলকাতার হাইকোর্টে স্থায়ী আইনজীবী হিসাবে যোগদান করেন। তাঁর পাশাপাশি আরো অনেক বিখ্যাত আইনজীবী যেমন বিধানচন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখের সঙ্গেও তিনি কাজ করেন।

আইনজীবী হিসাবে সফলতা অর্জন করলেও গুরুচরণ সিং তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্যই বেশি পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন পথপ্রদর্শক সাহিত্যিক এবং তাঁর রচনাগুলি বাঙালি সমাজের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি একটি স্বতন্ত্র শৈলী তৈরি করেছিলেন যা রস, উপহাস এবং প্রচ্ছন্ন কামনা দ্বারা চিহ্নিত ছিল।

গুরুচরণ সিং শুধুমাত্র একজন লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিকও। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি কংগ্রেস পার্টির সদস্য ছিলেন এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

গুরুচরণ সিং ১৯৫৩ সালের ৩০ মার্চ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি অমূল্য সম্পদ রেখে গেছেন। তাঁর রচনাগুলি এখনও আজকের পাঠকদের দ্বারা উপভোগ করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়।