ঘুলাম নবী আজাদ




শিক্ষা আর রাজনীতি - মাত্র দুটি কথার মধ্যেই আজাদের জীবনসম্পর্কিত কাহিনীর বীজ বপন করা হয়েছে। স্বাধীনতার আন্দোলন ও তার পরে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায়ও তিনি ছিলেন সক্রিয়। জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, ভারত সরকারের বিদেশমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বস্ত সহকর্মী - আজাদ একটি সর্বতোমুখী ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
জন্ম ও শৈশব
ঘুলাম নবী আজাদ ১৯৪০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের সোপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দিন মোহাম্মদ ভাট। পিতা ছিলেন একজন প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং তিনি কন্যা সন্তানদেরও পড়াশোনায় উৎসাহিত করতেন। তাই আজাদ তাঁর বোনদের সঙ্গে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শৈশবে তিনি একটি মাদ্রাসায় আরবি এবং ফারসি ভাষাও শিখেছিলেন।
শিক্ষাজীবন
আজাদ শৈশবকাল থেকেই একটি প্রখর মস্তিষ্কের অধিকারী ছিলেন। তিনি লেখাপড়ায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। সোপুরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি সিটি লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। দশম শ্রেণীর পরে তিনি তৎকালীন প্রিন্স অফ ওয়েলস কলেজ (বর্তমানে শ্রীনগরের গভর্নমেন্ট কলেজ) ভর্তি হন। সেখান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও একটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজনৈতিক জীবন
রাজনীতির সঙ্গে আজাদের পরিচয় ঘটে তাঁর শিক্ষাজীবনেই। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি ‘নেশনাল কনফারেন্স’ দলে যোগদান করেন। ছাত্র রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৬২ সালে তিনি জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় নির্বাচিত হন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুটা ছিল খুবই উজ্জ্বল। ১৯৮২ সালে তিনি জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে কাশ্মীরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি ঘটে।
১৯৮৪ সালে তিনি জাতীয় কনগ্রেসে যোগদান করেন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। ১৯৯১ সালে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর তিনি সংসদীয় বিষয়মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং অবশেষে বিদেশমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিদেশমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারতের কূটনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
অবদান
ঘুলাম নবী আজাদ তাঁর জীবনে অসংখ্য অবদান রেখে গেছেন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে তাঁর কাজ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তাঁর নেতৃত্বে জম্মু-কাশ্মীরে শিক্ষার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্যও কাজ করেছিলেন।
তাঁর রাজনৈতিক অবদানও অসাধারণ। তিনি ভারতের একজন দক্ষ এবং দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি সর্বদা জাতীয়তাবাদী মনোভাবের প্রচার করেছিলেন। তিনি কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের জন্যও কাজ করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন
ঘুলাম নবী আজাদ একজন সহজ, বিনয়ী এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী। তিনি দুর্নীতি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবসময় কণ্ঠস্বর তুলেছিলেন। তাঁর নীতিনিষ্ঠা এবং সততা তাঁকে সমস্ত রাজনৈতিক দলের রাজনীতিবিদদের কাছে সম্মানিত করে তুলেছিল।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল অত্যন্ত সুখী। তিনি ১৯৬৪ সালে তাঁর কলেজ জীবনের সহপাঠী শমিস আজাদকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুটি কন্যা রয়েছে।
পুরস্কার এবং সম্মাননা
ঘুলাম নবী আজাদের অসাধারণ অবদানের জন্য তাঁকে বেশ কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ‘পদ্মবিভূষণ’ পেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘আচার্য রাজীব গান্ধী জাতীয় একতার পুরস্কার’, ‘হেমবর্ধন দ্বার পুরস্কার’ এবং ‘মাদার তেরেসা পুরস্কার’ সহ আরও অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
মৃত্যু
ঘুলাম নবী আজাদ ২০১২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে রাজনৈতিক জগতে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ এবং একজন মহৎ ব্যক্তিত্ব। তাঁর কাজ এবং অবদান ভারতের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে সবসময় মনে রাখা হবে।