চম্পাই সোরেন।




বাবা মা অভাবী বলেই আমায় বলি দিয়েছিল। এই কথাটা বলার সময় চম্পাইয়ের স্বরে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। সোজাপ্রান প্রতিবন্ধী দম্পতির ঘরে জন্ম এক বোবা সন্তানের। কিন্তু তার বোবা হওয়াটা কেউ বুঝতে পারেনি। তার বাবা মায়ের মতোই সুস্থ অবস্থায় তার জন্ম। কিন্তু ১ বছর বয়সে ঠাণ্ডা লাগার পর আর মুখ খুলে কথা বলতে পারেনি চম্পাই।
ছোটবেলা থেকেই একলা একলা থাকত চম্পাই। রাস্তায় বেরোলে ছেলেমেয়েরা তার সঙ্গে কথা বলত না। নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হতো। এভাবেই কেটে যায় তার কিশোরাবস্থা। যৌবনে পা দেয়ার পরই অসহ্য দুঃস্বপ্নের মতো হাজির হয় চম্পাইর জীবনে।
একদিন রাতে রান্নাঘরে রান্না করছিল চম্পাই। হঠাৎ তার মামা সেখানে এসে জোর করে দরজা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ আগে অবধি রান্না ঘরে বাজছিল গুনগুন সুর। চুলায় জ্বলছিল অগ্নিশিখা। সবকিছুই যেন এক মুহূর্তে নিভে গেল। চম্পাই কী করবে, কিছু বুঝতে পারছে না। চিৎকার করতে পারছে না, সাহায্য চাইতে পারছে না। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বেরোচ্ছে না। তার মামা তার মুখ চেপে ধরে রেখেছে। দুর্বল চম্পাইর শরীর সহজেই পরাজিত হয়ে যায় তার মামার সামনে।
তারপরের কী, জীবন নামক অন্ধকার বিরান জঙ্গলে হারিয়ে যায় চম্পাই। তার ভাবনার জগতে আলো জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে তার শরীর এখন পুড়ছে মরুভূমির রোদে। তার আত্মা তৃষ্ণার্ত, চিৎকার করতে চায়, সাহায্য চাইতে চায়। কিন্তু কেউ শুনছে না।
কষ্টের এই অতল গহ্বরেই নতুন মাতৃত্বের অনুভূতি নিয়ে আসে চম্পাইয়ের জীবনে কিছুটা আলো। তবে এই আলোও অল্প সময়ের। তার প্রথম সন্তানটি মৃত অবস্থায় জন্মায়। দ্বিতীয় বারটি জন্মের সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় চম্পাইয়ের। কোনো রকমে তাকে বাঁচানো যায়। কিন্তু তার শরীর আর নতুন কোনো প্রাণ ধারণ করার উপযুক্ত নয়।
এরপর চম্পাইয়ের জীবনে এল তার জীবনের সঙ্গী বিশ্বনাথ। দিব্য প্রতিবন্ধী বিশ্বনাথ চম্পাইকে ভালোবেসে ফেলে নিজের স্বাধীন জীবনটাকে। তারপর তাদের জীবনে আসে বিশ্বনাথের বিয়ে করা ছেলে শিবু। চম্পাইয়ের জীবনে প্রথম হাসির রেশ আনে শিবু। এরপর তাদের ঘরে আরো দুটি সন্তানের জন্ম হয়।
এরপর থেকে শুরু হয় চম্পাইয়ের সংগ্রামের অন্য এক অধ্যায়। তাকে এখন তার ঘর সংসারের পাশাপাশি রোজগার করতেও হয়। সে কাপড় সেলাই করে, ফলমূল বিক্রি করে। এমনকি গাড়িও চালায় চম্পাই।
চম্পাইদের গ্রামটা ছোটো। সবাই একে অপরকে চেনে। গ্রামের প্রায় সবাইই জানে চম্পাইয়ের দুঃখের কথা। তাই তারা সবাই চম্পাইকে খুব সহায়তা করে। কিন্তু এমনও কিছু লোক আছে যারা চম্পাইয়ের এই সহযোগিতাকে সঠিকভাবে নেয় না। বিশেষকরে চম্পাইয়ের স্বামী বিশ্বনাথের সম্পত্তি নিয়েই তাদের মধ্যে এই বিরোধ।
গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে একদিন ডাক আসে চম্পাই। তাদের ঘরে সমস্যা হচ্ছে শুনে পঞ্চ মশাই রা আসতে চান। তবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় চম্পাই তাদের ঘরে প্রবেশ করতে দিতে পারবে না। চম্পাইয়ের স্বামী তাকে তাদের সমস্যা সমাধানে যাওয়ার জন্য খুব বলে। চম্পাই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সে যাবে কি যাবে না। শেষ পর্যন্ত সাহস করে যায় চম্পাই। মুখ দিয়ে কিছু বেরোয় না দেখে কিছু লোক হাসতে থাকে। কিন্তু তার ঠিক বিপরীত দিকে বসা পঞ্চ মশাইরা সমস্যার কথাবার্তা শুনে সিদ্ধান্ত নেন দুদলের ঝগড়ার ফয়সালা হবে। চম্পাইয়ের প্রতিবন্ধী হওয়ায় জোর করে তাকে ঘরে আটকে রাখার জন্য চেষ্টা করলে পঞ্চ মশাইরা তাকে পুরোপুরি সাপোর্ট করেন।
চম্পাই বলে, একটা সময় ছিল যখন আমার মনে হতো আমার জীবন এবার শেষ, আমি আর বাঁচবো না। কিন্তু আমার মমতা, আমার সন্তানরা আমাকে জীবনের প্রতি আশা জাগিয়েছে। আমার স্বামী বিশ্বনাথ বিশ্বাস করে আমার উপর। সেই বিশ্বাস আমাকে শক্তি দেয়। আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমি গাড়ি চালাতে পারবো। কিন্তু আমি চালাচ্ছি। আমি সাহস জোগাচ্ছি মানুষকে। বলছি, আমার করতে পারলে তুমিও পারবে। সব প্রতিবন্ধীদের বলি, হাল ছেড়ো না। কারণ প্রতিবন্ধী মানুষরাও সমাজে সমান অধিকারের অংশীদার। সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারে।"