ছে গুয়েভারা, বিপ্লবের আইকন




যুগে যুগে সর্বত্র বিপ্লব হয়েছে। বিপ্লবে জন্ম নিয়েছেন নেতা। নেতারা হয়েছেন জনগণের হিরো। সেই হিরোদের জীবন হয়েছে দিশা, দর্শন ও প্রেরণা। এমনই একজন বিপ্লবের বিশ্বনেতা হলেন চে গুয়েভারা।
গুয়েভারা জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৮ সালের জুন মাসে আর্জেন্টিনার রোজারিওতে। তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক, বিপ্লবী প্রতিবাদকারী, লেখক, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং গেরিলা যোদ্ধা। তিনি কিউবা বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ भूमिका পালন করেছিলেন, মার্ক্সবাদে দৃঢ় আস্থা রেখে বিপ্লবী আন্দোলনের স্বরূপ পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
গুয়েভারা জন্মগতভাবেই অ্যাস্থমা রোগী ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফুটবল, রাগবি এবং গলফের মতো খেলাধুলায় তিনি দক্ষ ছিলেন। শৈশবেই তিনি সামাজিক বৈষম্য ও অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদী মনোভাব তৈরি করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি বুয়েনোস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।
১৯৫১ সালে মেডিসিনের শিক্ষা শেষ করে গুয়েভারা দক্ষিণ আমেরিকায় ভ্রমণে বের হন। এই ভ্রমণটি তার জীবনকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করে। তিনি স্বচক্ষে দেখেন কীভাবে দারিদ্র্য, রোগ এবং অবিচার মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই ভ্রমণের পর তিনি আধিকারিক মেডিসিন ছেড়ে বিপ্লবের পথে পা বাঁধেন।
১৯৫৩ সালে গুয়েভারা গুয়াতেমালা যান এবং সেখানে আর্জেন্টিনার সাবেক রাষ্ট্রপতি জুয়ান পেরনের সমর্থক হন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের পরে গুয়েভারা গুয়াতেমালা থেকে পালিয়ে যান এবং মেক্সিকোতে আশ্রয় নেন।
মেক্সিকোতেই গুয়েভারার সাক্ষাৎ হয় কিউবান বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো এবং তার ভাই রাউলের সঙ্গে। তারা কিউবায় কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটা গেরিলা বাহিনী গঠন করছিলেন। গুয়েভারা তাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তাদের সঙ্গে কিউবায় যান।
কিউবায় গুয়েভারা প্রচার ও উসকানি দিয়ে গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। তিনি তার সামরিক দক্ষতা এবং রণকৌশলের জন্য খ্যাত হন। ক্রমশ কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের শক্তি বৃদ্ধি পায়, এবং ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে তারা ক্ষমতা দখল করতে সফল হন।
কিউবা বিপ্লবের পর গুয়েভারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদে নিযুক্ত হন। তিনি শিল্প মন্ত্রী হিসাবে কিউবা অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসাবে কিউবার বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয় এবং বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ান।
গুয়েভারার কিউবায় থাকার সময়ই সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শীতল যুদ্ধ প্রচণ্ড হয়ে ওঠে। গুয়েভারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র নিয়োগের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। যার ফলে কিউবা সংকট সৃষ্টি হয়।
১৯৬৫ সালে গুয়েভারা কিউবা ত্যাগ করেন এবং বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য কাজ করতে শুরু করেন। তিনি কঙ্গো এবং বলিভিয়ায় গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করেন। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে বলিভিয়ায় গুয়েভারা বলিভিয়ান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন।
গুয়েভারার মৃত্যুর পর তিনি একটি বিপ্লবী চিহ্নে পরিণত হন। তার ছবি বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ এবং বিপ্লবের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তার দর্শন এবং আদর্শ এখনও আজকের বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করে।
গুয়েভারা ছিলেন একজন জটিল এবং বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তিনি একই সঙ্গে একজন বিপ্লবী, সামরিক নেতা এবং বিপ্লবের তাত্ত্বিক ছিলেন। তার জীবন এবং কাজ এখনও ব্যাপকভাবে আলোচনা এবং বিতর্কের বিষয়।
তবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে গুয়েভারা একজন বিপ্লবী আইকন, যিনি বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী আন্দোলনে গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন। তার জীবন এবং কাজ আমাদের অন্যায়, নিপীড়ন এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়।