জাকির হুসেন




তিনি স্বপ্ন দেখতেন তালের

মনে পড়ছে, তিনি অর্কেস্ট্রা রিহার্সালের শেষে হঠাৎ এসে বললেন, ‘আজ সারারাত জেগে বসে থাক, গান বাজাবে, তাল নেবে, আমি কথা বলে যাব, তুমি লিখবে।’ তখন প্রায় ১০টা বাজায়। আমরা বসলাম। হঠাৎ বললেন, ‘একটু চা করে নিয়ে এসো। আর সিগারেট এনে দেবে?’ চা আর সিগারেট নিয়ে এসে বসলাম। সিগারেটে দু-তিনটা দম নিয়ে আবার সেই কথা বললেন, ‘তুমি লিখবে, আমি বলব।’ কী বলবেন, কী লিখব? এর কি আগে কোনও খসড়া আছে? না, কিছুই নেই। তিনি শুরু করলেন অবিরত বলতে। বলতে বলতে সুরটা যেন অনেক আগে থেকেই তৈরি, সেটা সুরে গাওয়া গেল। মাঝেমধ্যে বললেন, ‘এখানে একটু তালের তাড়তাড়ি লাগবে, এখানে লাগবে ধীরগতি।’ মাঝে মাঝে গানের রেখাটাও বদলে ফেললেন। কখনও কখনও হঠাৎ বলে দিলেন, ‘এই লাইনটা খুব মিষ্টি লাগছে। বলো তো, আর কিছু লাইন যোগ করার নেই?’ তোলেন আমার বেরিয়ে যাওয়া গানটা, ‘যেতো সে কোথায়’। বললেন, ‘এটার তো সুর আমিই আগে দিয়েছিলাম। অনেকদিন শোনা হল না। আচ্ছা একটু বাজাও তো।’ আমি তাড়াতাড়ি গানটা বাজিয়ে শোনাতে লাগলাম। শুনে বেশ মুগ্ধ হয়েছিলেন। বললেন, ‘এই গানটা আবার নতুন করে একটু সাজিয়ে নিতে হবে।’

আমাদের বাড়ির তিনি নিয়মিত অতিথি। বাড়িতে আসলে সঙ্গে সঙ্গে গানের কথা হয়। আমার বাবার তৈরি গান তিনি শোনেন। বাবাও তাঁর তৈরি গান শোনেন। কখনও কখনও বলেন, ‘গানটা খুব সুন্দর হয়েছে। আরও একটু কিছু করা যাবে কি না?’ তো আবার কখনও বলেন, ‘আর একটু রিদমের তাড়তাড়ি বা ধীরগতি লাগবে।’ রিদমের কথা বলতেই তাঁর নিজের তালের সঙ্গে পরিবেশন করেন বাবার গানের কথা। মুগ্ধ হয়ে যায় সবাই।

তাঁর তালবাদনের মধ্যে যতটা সরলতার সঙ্গে জটিলতার মেলবন্ধন ছিল, ততোটা আর কারও মধ্যে দেখিনি। কত আপন করে সবাইকে ব্যবহার করতেন! তাঁর প্রত্যেক ছাত্র সব সময় অনুভব করতেন, তাঁরা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। কত দিন ধরে কে কী কাজ করলেন না করলেন, সেসব বিষয় তিনি কখনও মনে রাখতেন না। এমনকী নিজে কী সুর তৈরি করেছেন সেটাও কখনও মনে রাখতেন না। শিষ্যরা তাঁর সুরকে নিজেদের সুর বলে প্রকাশ করলেও কখনও আপত্তি করতেন না।

শওকত হুসেনের আত্মজীবনী ‘আমার আত্মসম্পূর্ণতা’ বইটির অনুলিখন করার সময় জানতে পারি, তাঁর স্বপ্ন ছিল কেবল তালবাদন নিয়ে একটি বিশালকলেবর বই লিখবেন। সেখানে তিনি তালের উৎপত্তি থেকে নিয়ে আধুনিক তালের নানা দিক তুলে ধরবেন।

তিনি স্বপ্ন দেখতেন তালের। স্বপ্ন দেখতেন, সারা দেশের তাবলগিরির সেরা সেরা সব তালবাদকদের নিয়ে তিনি একটি অ্যাকাডেমি তৈরি করবেন। সেখানে তিনি তাঁদের নিজে শিক্ষা দেবেন, আর কেবল তা-ই নয়, তাঁরা গানবাজনা নিয়েও আলোচনা করবেন।

দুঃখের বিষয়, তিনি তাঁর আবেগগুলোকে বইয়ের পাতায় রূপান্তর করার সুযোগ পাননি।