ফ্লিক্সবাস
আমি সবসময় ভ্রমণ করতে পছন্দ করি। ভ্রমণ মানে শুধু নতুন জায়গা দেখা নয়, নতুন সংস্কৃতি, ভাষা এবং মানুষের সঙ্গে পরিচয়, নতুন কিছু শেখা। আর ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আনন্দ হলো রাস্তাঘাট। আমার মনে আছে কত রাস্তা পায়ে হেঁটেছি, রাস্তার পাশে বসে সারাদিন কাটিয়েছি, সাইকেলে চড়ে ঘুরেছি, রেলগাড়িতে ঝিমুক দিয়ে দিন পার করেছি। কিন্তু রাস্তাঘাটের সঙ্গে আমার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে। রাস্তা ভালোবাসি, কিন্তু রাস্তায় বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। কারণ আমি অসুস্থ হয়ে পরি।
একবার নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম থেকে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে যাওয়ার কথা। এটা সড়কপথে প্রায় দুইশ কিলোমিটার। আমি প্রথমে ট্রেনে যেতে চেয়েছিলাম। সুন্দরভাবে বসে সিট বেল্টটি পড়ে সুন্দর সুন্দর ভালোবাসার গান শুনতে শুনতে রাস্তাকে কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, সেদিন ট্রেনের টিকিট পাওয়া গেল না। তাই বাস ছাড়া উপায় ছিল না। আমি সারাদিন রাস্তাঘাটে কাটাতে একটুও রাজি ছিলাম না। কিন্তু কী করার, ট্রেনের টিকিট নেই। তাই বাসের টিকিট কেটে ফেললাম।
বাস ছাড়ল আমস্টারডামের সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে। বাসটা দেখতে বেশ বড়। ঠিক ঠাক মনে নেই কতটা বড়। কিন্তু নিঃসন্দেহে কয়েকটা রেলকোচের সমান। একটু হেঁটে গিয়ে বাসে উঠলাম। আমার সিটটা একদম সামনে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবটা কাঁচ। এরকম কাঁচঘরের মতো বাসে আমার আগে কখনও ওঠা হয়নি। আমি জানলায় মুখ লাগিয়ে দিলাম। বাসটা যখন চলতে শুরু করলো, তখন আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
শুরুতে আমস্টারডাম শহর। সুন্দর সুন্দর রঙিন বাড়ি, উঁচু উঁচু ভবন, শপিং মল। সামনে এগোতে এগোতে শহর ছোট হতে লাগল, প্রকৃতি বড় হতে লাগল। আর ঠিক তখনই শুরু হলো সবুজের রাজ্য। যতদূর চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে হয়তো একটা গাড়ি দেখা যায়, নয়তো একটা বাড়ি। বাসটা বেশ বড় হলেও তারপরও আমার মনে হলো যেন আমি একলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। আমার পাশে কেউ নেই, শুধু সবুজ। প্রকৃতির বুকে আমি হারিয়ে গেলাম।
একসময় বাসটা একটা বাসস্টপে দাঁড়ালো। বাসস্টপের পাশে একটা মুদি দোকান। দোকানটাও একদম মাঠের মধ্যে। কয়েকটা বাড়ি আছে, কিন্তু সবুজের মাঝে। দোকানের ভেতর লোকজন। কেউ কফি খাচ্ছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে। দোকানের কিছু দূরে একটা বেঞ্চ। বেঞ্চে বসে দুজন মহিলা গল্প করছে। বেঞ্চের আশেপাশে কিছু গাছ। দূরে একটা গাড়ি যাচ্ছে। গাড়ির পেছনে উড়ছে ধুলো। সেই ধুলো গিয়ে মিশেছে আকাশের মেঘের সঙ্গে। সারা জায়গাটাকে দেখলে মনে হয় যেন একটা পেইন্টিং।
বাসটা আবার চলতে শুরু করলো। আমি মুগ্ধ হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। হঠাৎ বাসটা একটা পুলে থামলো। আমি ভাবলাম বাসটা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু না, বাসটা পুলে ঢুকলো। বাসের চারদিকে পানি। আমি একটু ভয় পেলাম। কিন্তু আমার পাশে বসা একটা মহিলা বললেন, “ভয় পেয়ো না, এটা আমাদের নেদারল্যান্ডের বৈশিষ্ট্য। আমাদের দেশের অনেক পথই পানির মধ্যে দিয়ে যায়।” আমি বললাম, “ওহ, আচ্ছা।”
বাসটা পানির মধ্যে কিছুদূর যাওয়ার পরে আবার রাস্তায় ফিরে এলো। আমি আবার জানলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এবার আমি আগের চেয়েও বেশি মুগ্ধ হলাম। রাস্তার দুই পাশে সবুজ। দুই দিকেই দেখতে দেখতে শেষ হয় না। মাঝে মাঝে একটা খাল দেখা যায়। খালের দুই পাশে সারি সারি ঘর। ঘরগুলোর সামনে সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। এমনকি ঘরের ছাদের ওপরেও রয়েছে ফুলের গাছ। নেদারল্যান্ডের প্রকৃতি আমাকে মুগ্ধ করে দিল।
বাসটা আবার একটা বাসস্টপে থামলো। এবারের বাসস্টপটা একটা গ্রামের মধ্যে। গ্রামটা ছোট্ট। দুই দিকে রাস্তা। দুই দিকেই ঘরবাড়ি। ঘরবাড়ির সামনে ফুলের গাছ। গ্রামের মাঝে একটা গির্জা। গির্জার ঘণ্টাটা বাজছে। বাজছে তো বাজছেই। গির্জার পাশে একটি পার্ক। পার্কে শিশুরা খেলছে। শিশুদের হাসি শুনে মনটা ভালো হয়ে গেল।
বাসটা গ্রামটা পার করলো। আমরা আবার সবুজের মাঝে। দুই দিকেই সবুজ। মাঝে মাঝে একটা বাড়ি দেখা যায়। বাড়িটা একদম মাঠের মধ্যে। বাড়ির চারদিকে ফুলের গাছ। বাড়ির সামনে খেলছে দুইটা শিশু। শিশু দুটোর সঙ্গে খেলছে একটা কুকুর। আমার মনে হলো, এখানকার জীবন সত্যিই শান্তিপূর্ণ। এখানে কোনো শोरগোল নেই, কোনো দূষণ নেই। শুধু আছে শান্তি, সবুজ আর প্রকৃতি।
বাসটা চলতে চলতে একটা