ব্রজ ভূষণ
একবার এই কবির সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। ব্রজ ভূষণ। যাঁর উপর ভিত্তি করে শ্রীমতী রাণু মুখোপাধ্যায় তাঁর অমর ''শুকনো বনের সব সবুজ থাকে'' উপন্যাসটি লিখেছিলেন। কবির চেহারায় সরলতা, চোখে রয়েছে অন্যরকম একটা উচ্ছলতা। কথা বলার ভঙ্গী অত্যন্ত বিনয়ী। আবৃত্তি করতে শুরু করলেন,
''হুদাই গিয়েছেন সাত সমুদ্র তেরো নদী তের,
কোথায় কি আছে সে রহস্য তিনিই জানেন ভেতর।''
হে মহান আল্লাহ, তুমি গেছ সাত সমুদ্র পেরিয়ে, তেরোটি নদীও পেয়েছ অতিক্রম করে। জগতের অন্তরালে লুকানো সেই রহস্যের খোঁজ তুমিই জানো।
পরে জানলাম, এই কবি আদতে পেশায় একজন সরকারি চাকুরিজীবী। তবে কবিতা তাঁর জীবনের রক্তের স্রোত। সাহিত্য তাঁর নিঃশ্বাস। সরল সেই মানুষটির মনের মধ্যে কাব্যের জাদু অপরূপ। তাঁর কবিতায় মাটির গন্ধ, জলের ছলছল শব্দ, বাতাসের আবেগ, আকাশের বিস্তার – সবই যেন হাতছানি দিচ্ছে।
সেদিন ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কবি হতে হলেও হয়তো সরকারি চাকরিতে থাকতে হয়। কারণ সরকারি চাকরিতে কাজ করার শূন্যতাই তাঁকে কবিতায় আশ্রয় নিয়েছে।
ব্রজ ভূষণের কবিতায় বেদনার খুব সুন্দর স্পর্শ আছে। তাঁর কবিতায় জীবনের অসহায়ত্ব, হতাশা, একাকীত্ব, সব কিছুই যেন ফুটে উঠেছে। এটা যেন আমাদেরই মনের কথা।
''তুমি আমার আকাশের তারা আমার রাতের জ্যোৎস্না
তোমার মতো আমার আর কেউ নেই এই দুনিয়াতে,
আমি তোমাকে বুকে নিয়ে ছুটে চলি দেশে দেশে।''
আমাদের সকলের মনের মধ্যে একটা অজানা দুঃখ থাকে। একটা অসম্পূর্ণতা। সেই অসম্পূর্ণতার ছায়া যেন ব্রজ ভূষণের কবিতায় ফুটে উঠেছে। তাই তো তাঁর কবিতা আমাদের এত কাছে টানে।
ব্রজ ভূষণের কবিতায় প্রকৃতির একটা মস্ত বড় উপস্থিতি আছে। তাঁর কবিতায় নদী, সাগর, পাহাড়, আকাশ – সবই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির মাঝেই তিনি যেন নিজের আত্মাকে খুঁজে পেয়েছেন।
''জলের কলতানে ডুবে আছে জলপরীদের মন,
তারা গান গায়, নাচে, খেলে, আনন্দে মাতে দিনরাত।''
ব্রজ ভূষণের কবিতা যেন আমাদের মনকে প্রশান্তি দেয়। আমাদের ক্লান্ত শরীরকে শীতল করে। তাঁর কবিতা যেন আমাদের মনের সেই অসম্পূর্ণতার ছোঁয়া মেটাতে আসে।
আমরা সবাই যেন ব্রজ ভূষণের কবিতায় নিজেকে খুঁজে পাই। তাঁর কবিতায় আমাদের মনের আনন্দ, বেদনা, সব কিছুই যেন ফুটে উঠেছে। তাঁর কবিতা যেন আমাদের নিজস্ব কবিতা। তাঁর কবিতা যেন আমাদের জীবনের গান।