যার দয়াতে মহারাজ মহারানীরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন




সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া সম্পদগুলোর কথা যখন হয়, তখন একদল মানুষের কথা না বললেই নয়, যাঁরা ছিলেন রাজকীয় আতিথেয়তার মেরুদণ্ড। ওদের একটা বড় অংশই এসেছিলেন দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কয়েক শো বছর আগেও বাঙালির বাড়িতে দক্ষিণ ভারতীয় রাঁধুনিদের ডাকা হত বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য। তাঁরা এসে বানিয়ে যেতেন বিভিন্ন মুখরোচক রান্না, আর স্বাদে মুগ্ধ করতেন বাঙালিদের। আর রাজবাড়িতেও তাঁরা ছিলেন অতিথি।

আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে, সেই ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা চামুণ্ডিরাজ ওয়াড়িয়ার দ্বিতীয় এর নির্দেশে রান্না প্রস্তুত করার জন্য চামরাজনগরের কাছে অবস্থিত চেঙ্গমারাসা এলাকা থেকে মুস্তফা নামে একজন দক্ষ রাঁধুনিকে নিয়ে আসা হয়। হাতের খেলায় তিনি যে সুস্বাদু খাবার বানাতে পারতেন, তাতেই মহারাজা ও মহারাণীদের মন জয় করে ফেলেন।


সময়ের সাথে সাথে তাঁর দক্ষতা ও তাঁর বানানো রান্নার জনপ্রিয়তা এতটাই বাড়ে যে, মহারাজা ওয়াড়িয়ারদের নির্দেশে তাঁকে রাজপ্রাসাদের রাঁধুণিতে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। মুস্তফার রান্নার গুণকীর্তি রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।


রাজপ্রাসাদের বিশেষ অনুষ্ঠান এবং সরকারি দাওয়াতের আয়োজনের ভারও তাঁর উপরই বর্তায়। এমনকি ব্রিটিশ শাসকরাও মুস্তফার রান্নার গুণ অপারগ হয়ে স্বীকার করে নেন। তাঁদের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে আসা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মুস্তফার হাতে বানানো রান্না খেয়ে মুগ্ধ হতেন।


মুস্তফার খাবারের জাদু সমগ্র রাজ্যজুড়ে এমনভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, লোকেরা অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও রাজপ্রাসাদে আসতেন মুস্তফার রান্না খাওয়ার জন্য। রাজপ্রাসাদের রান্নাঘরের দায়িত্বে থাকাকালীনই মুস্তফার মাথায় একটা দুষ্টু চিন্তা আসে। তিনি ভাবেন, রাজপ্রাসাদের বিখ্যাত খাবারগুলোকে কী করে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।


একদিন তিনি মহারাজা চামুণ্ডিরাজ ওয়াড়িয়ার দ্বিতীয় এর কাছে তাঁর এই ইচ্ছে প্রকাশ করেন। মহারাজা মুস্তফার এই প্রস্তাবকে সাগ্রহে সম্মান করেন এবং রাজপ্রাসাদের বাইরেও একটি রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতি দেন। এইভাবেই ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে মুস্তফা রাজপ্রাসাদের উদ্বৃত্ত জায়গাতেই খোলেন মহারাজা ক্যাফে। এই ক্যাফে খোলার পর থেকে রাজপ্রাসাদের স্বাদ জনসাধারণের কাছে অনেক সহজলভ্য হয়ে যায়। ক্যাফেটি জনসাধারণের মধ্যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।


মহারাজা ক্যাফেতে লোকজন এসে শুধু রাজপ্রাসাদের স্বাদই পেতেন না, এখানে প্রচলিত ছিল অভিনব এক আতিথেয়তা। এখানে গ্রাহকদের কফি সরবরাহ করা হত নানা সুন্দর পেয়ালায়। এতে গ্রাহকদের মধ্যে আলাদা ধরণের উত্তেজনা দেখা যেত। অতিথিদের জন্য একটি বিশেষ পানীয় তৈরি করেছিলেন মুস্তফা। সেই পানীয়টি ছিল নামে ‘চিনারাগুলিনা সরবত’। এই সরবতটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, মহারাজা ক্যাফে ‘চিনারাগুলিনা সরবত’ নামেও পরিচিত ছিল।


শুধুমাত্র রান্না বা পানীয়ই নয়, মহারাজা ক্যাফেতে পরিবেশন করা হত বিভিন্ন ধরণের স্ন্যাক্স। এই স্ন্যাক্সগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ‘ভাদে’। ভাদে হল পাতলা আটার তৈরি এক ধরণের পাঁপড়। এর উপরে দেওয়া হত পনির ভর্তা, চাটনী, নারকেলের চাটনি, পেঁয়াজ, টমেটো ও ধনেপাতা। এ ছাড়াও মহারাজা ক্যাফেতে মিলত মাদ্রাস তোঁদের, আয়ড়ি তোঁদের ও কোলুর বিরিয়ানি।


১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মুস্তফা অবসর নেন রাজকীয় চাকরি থেকে। তবে মহারাজা ক্যাফের দায়িত্ব তাঁর বংশধররা বহন করে চলেছেন। মুস্তফার মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রশিদ রাজা ক্যাফের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁর পরে আশ্রাফ রাজা। এরপর ক্যাফের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মুস্তফার নাতি রশিদ আহমেদ। রশিদ আহমেদের পরে ক্যাফের মালিকানা ও দায়িত্ব নিয়েছেন মহম্মদ তাফসিল রাজা।