রকেশ পাল
সেন্ট্রাল জেলে নিজের প্রেরণাকে তুলে ধরে লিখেছেন রকেশ পাল।
আমার জীবনের প্রথম অর্ধেক প্রায় পরিপূর্ণ হয়েছে। এই অর্ধেকটা জীবন কিভাবে কেটেছে, তা নিয়ে ভাবলে মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যাই। কেমন যেন সেই সময়! যদিও সেই সময়ের অনেক কিছু মনে নেই, কিন্তু কিছু কিছু ঘটনার কথা মাঝে মাঝে খুব স্পষ্টভাবে মনে পড়ে। আজ সে সব ঘটনার কথাই বলব।
জন্মের পর প্রথম দু’বছর মা-বাবার সঙ্গে কেটেছে। তারপর যেমনটা সচরাচর ঘটে, তেমনই হয়েছে আমার ক্ষেত্রেও। দু’বছর বয়সে বাবা-মায়ের কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চার ভাই-বোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোট। আমার দু’বছর বয়স্ক বড় দাদা ও দু’বছর বয়স্ক বড় বোনের পাশাপাশি এক বছর বয়স্ক আরেক বোন ছিল। বাবা-মায়ের চারটি সন্তানকে নিয়ে চলা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে মা বাবার পিতৃালয়ের লোকদের কাছে আমাকে সাময়িকভাবে রেখে আসেন।
বাড়ি থেকে লোকেরা যখন আমাকে বাবার পিতৃালয়ে নিয়ে আসল, তখন তাদের সঙ্গে বড় বোন ছিল। বাড়িতে আসার পরে আমার বড় বোন তখন ছেলেদের মতো কাপড় পরে বেড়াত। আমি ভেবেছিলাম, বাড়িতে আরও একটা ছেলে এসেছে। প্রথম দিনটি খুব সুন্দরভাবেই কাটিয়েছি। আশেপাশের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে দিন কেটে গিয়েছে। কিন্তু পরদিন সকালে উঠে দেখি আমাকে মেয়েদের কাপড় পরানো হয়েছে। এই দৃশ্য দেখে মনে হল যেন গায়ে আগুন লেগেছে। আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি অপমানজনক ঘটনা এটিই মনে হয়েছিল। ছেলেদের কাপড় পরে এতদিন খেলা করে এসেছি, আর আজ অন্যরকম কাপড় পরানো হচ্ছে। তখন মনে হয়েছিল এখানে আমার থাকা হবে না। কিন্তু বাধ্য হয়ে তখন সেখানে থেকেছি।
দিন যত গড়িয়েছে, আমার আশা আরো কমতে গেছে। এ বাড়িতে আমার কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। খাওয়ার কোনও নিয়ম নেই। দিনে দুইবেলা খাওয়াদাওয়া হয়। সকালে ভাত আর সন্ধ্যাবেলা ভাত। দুপুরে ভাত খাওয়া হয় না। অনেক সময় সন্ধ্যাবেলাও ভাত খাওয়া হয় না। দিনের মধ্যে কখনও কখনও মুড়ি বা চিড়ে দেওয়া হতো। একটু বড় হওয়ার পরে অর্থাৎ চার-পাঁচ বছর বয়সের দিকে একদিন সন্ধ্যাবেলা ভাত খাওয়ার সময় তরিতর করে পরিবেশন করা হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না, হঠাৎ কি হল? তারপর বুঝলাম, সেদিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশের উপর জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। সেটাই শুনে সবাই এতটা ভয় পেয়েছে যে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সেদিনের সেই ঘটনা আমার মনে গেঁথে গেছে।
আমি যতদিন বাবার পিতৃালয়ে ছিলাম, ততদিন আমার মা-বাবার খবর পেতাম না। মাকে খুব মিস করতাম। প্রতিদিন সকালে খাবার খেয়ে যখন সবাই কাজে বেরিয়ে যেত, তখন আমি বাড়িতে একা থাকতাম। বাড়ির সামনে তিনটি আমেরিকান গাছ ছিল। দু’টি গাছে আম ছিল, আর একটি গাছে আম ছিল না। আম ছিল না যে আমেরিকান গাছে, সেটি ছিল আমার আশ্রয়স্থল। সেখানে গিয়ে আমার মা-বাবার কথা ভাবতাম, তাদের মিস করতাম।
এভাবে ছয়-সাত মাস কাটানোর পরে একদিন দুপুরের দিকে আমার মা আমাকে নিয়ে যেতে বাড়িতে এলেন। সাত মাস পরে আমার মা-বাবাকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলাম। মা আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। বাড়ি ফিরে গিয়েও দু’বছরের মধ্যে আমার জীবন অনেকটা বদলে গেছে। আমি দেখলাম আমার পরিবারের লোকজন দিনের বেলা বাসা থেকে বের হচ্ছেন। রাতে ফিরে আসছেন। এ কী হচ্ছে, তা আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
কিছুদিন পরে বুঝলাম, পরিবারের লোকজন টাকা আনতে বাইরে যান। মা আবার বিয়ে করেছেন। মা কার সঙ্গে বিয়ে করেছেন, তা আমি জানতাম না। মা আমার সৎ বাবাকে নিয়ে দু’তিনদিনের জন্য বেরিয়ে গেছেন। সেই সময়টাতে আমি একা বাড়িতে ছিলাম। একদিন বিকেলে বাড়ির সামনে খেলছিলাম, তখন দেখলাম একটা লোক আমার মা-বাবার বাড়ির গলি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাকে দেখে আমার দিকে এগিয়ে এল। কাছে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কাদের বাচ্চা?’ আমি বললাম, ‘আমি মা-বাবার বাচ্চা।’ তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাবা-মা কোথায়?’ আমি বললাম, ‘বাবা-মা বাইরে গেছেন।’ তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এই বাড়িতে একাই?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
আমার কথা শুনে সে আমাকে বলল, ‘এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এস। আমি তোমাকে তোমার বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যাব।’ আমি ভেবেছিলাম বাইরে গেলে আমার মা-বাবাকে দেখতে পেয়ে যাব। তাই আমি সেই লোকটির সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুদূর হেঁটে গিয়ে সে একটি সড়ক পার করে আরেকদিকে একটা গাড়িতে বসাল। গাড়িটি সারারাত ড্রাইভ করে সকালের দিকে আমাকে একটি বাজারে নিয়ে গেল। দিনের আলো দেখার পরে কিছু কিছু বুঝতে পারলাম। আমাকে যে লোকটি নিয়ে এসেছে, সে আমার আত্মীয় নয়। আমাকে সে লোক