শঙ্কর বাঁচলো কিভাবে?




সর্পদংশনের কেস আমি ইতিমধ্যেই দুটি আলোচনা করেছি আগের দুই পোস্টে। ঠিক তৃতীয় দিনেই আমাদের সামনে এমন একটা কেস এলো যা আমাদেরকে অনেক কিছু শেখালো। আর কিছু না হলেও আমাদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আর টিম হিসেবে আমাদের দুর্বলতাটা অন্তত খুলে দিয়ে গেলো।

রোগীর নাম শঙ্কর। বয়স আনুমানিক ৩৫। পেশা কৃষক। দেখে মনে হলো দিনমজুরও হতে পারে। রাত ১০ টায় এসেছে হাসপাতালে। আপনারা ভাবতে পারেন, রাতে ঠিক ১০ টায় কী করে কামড়ালো সাপটা। আর রাতে ঠিক ১০ টায় কী করে হাসপাতালে আসলো এই লোকটা। আপনারা ভুল ভাবছেন। তার কামড়ানোর সময় সম্ভবত ছিলো বিকেল ৪-৫ টার দিকে। কামড়ানোর পরে তার এলাকার একটা ডাক্তারের কাছে যায় সে। ঐ ডাক্তার ইতিমধ্যেই থেরাপি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ঠিক কি থেরাপি সেটা আমরা জানতে পারিনি। তার থেকে বের হয়ে আসার পরে আসে আমাদের হাসপাতালে।

তার সর্পদংশনের ইতিহাসে একটু অসঙ্গতি আছে। সে বলেছে যে, সে অনেক কাল আগে একবার সাপের দংশন খেয়েছিলো। কিন্তু তার হাতে কোন scar নেই। এছাড়া সে বলেছে যে, আবার অনেক কাল আগে কিছুদিনের জন্য সে টিকা নিয়েছিলো। বার্ষিক টিকা সে হয়তো নিয়মিত নেয়নি। ফলে তার রক্তে অ্যান্টিভেনমের অস্তিত্ব নিয়েও আমাদের একটু সন্দেহ আছে।

শঙ্করকে দেখার পরে আমাদের মনে হলো যে, এটা একটা নেউরোটক্সিক এনভেনোমেশন। সে ভীষণ প্যারেসিস হয়ে গেছে। তার দুই হাতের কোন মুভমেন্ট নেই। তার পা দুটোতে একটু একটু হলেও মুভমেন্ট পাচ্ছি। সে নিজে থেকেই রেসপায়ার করছে। কোন এয়ারওয়ে ম্যানেজমেন্ট দরকার হচ্ছে না।

টিম হিসেবে আমাদের দুর্বলতাঃ

আমাদের হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম নেই। কখনো ছিলো না। অথচ সাপের দংশন কেস এই এলাকায় খুব সাধারণ। পরের উপজেলায় হয়তো একটা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম আছে। কিন্তু সেটাও কাছের ব্যাপার না। সেটা আমাদের থেকে অন্তত ১০০ কিমি দূরে। অন্তত এক ঘন্টার পথ। আর এতদূর একটা ক্রিটিক্যাল কেসকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।

আমাদের হাসপাতালে ভেন্টিলেটরও নেই। কোন ক্রিটিক্যাল কেসকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য ভেন্টিলেটর একটা প্রাইমারি জিনিস। অথচ আমাদের সেটা নেই।

আমাদের কাছে একটা পালস অক্সিমিটার আছে। সেটাও খুব কাজে আসে না। কারণ সেটাটা কোন ঠিকমতো মেসারমেন্ট দিচ্ছে না।

এত কিছুর পরেও আমাদের কাছে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কেয়ারের অভাব আছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কেয়ারের অভাব বলতে আমি বুঝিয়েছি টোটাল কেয়ার। তার শরীরের পাশে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সবসময়ই জরুরি হয়ে থাকে। যেমন IV Fluide, ড্রপসেট, স্যালাইন, হালকা নরম কাপড়, মনিটরের জন্য একটা ষ্টল আর তার সাথে কিছু ডিসপোজেবল গ্লাভস। এসব জিনিস আমি ঠিক মতো পাচ্ছিলাম না। কারণ আমার আশেপাশের যারা কাজ করছে তারা আমার সাথে টোটাল কোঅপারেট করছিলো না। আমাদের হাসপাতালে প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা মতবাদ আছে। কেউই কারো কথা শুনতে রাজি না। এমনকি প্রত্যেকের মধ্যেই একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব আছে। আমি করবো না, সেটা বরং সে করুক। আমি শঙ্করকে বললাম যে, একটু বরফ নিয়ে আসো। সে আমার কথা শুনলো। কিন্তু তাকে দেখছিলাম যে, সে আমার কথাটা মন থেকে শুনেনি। আমি যখন তার কাছে বরফ নিয়ে আসার কথা বলছিলাম, এই সময়টাতে সে ভাবছিলো যে, এবার বরফ নিয়ে আসার চান্সটা সে পেল না। উল্টো এই চান্সটা পেলো সেই।

শঙ্করের কেসঃ

আমাদের টিমের এইসব দুর্বলতার মধ্যেও আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করেছি শঙ্করকে বাঁচানোর। আমি ক্রমাগত তার রেসপায়ারেশন চেক করেছি। তার রেসপায়ারেশন রেট ঠিক আছে। তার কিছু কফ জমেছে। সেই কফকে বারবার আমি স্যাকশন করে দিয়েছি। হেড আপ পজিশনে রেখে তার ওরোফ্যারিং থেকে সিথেটিক স্যালাইভা দিয়ে মুছিয়ে দিয়েছি। বিভিন্ন অঙ্গের সেনসরি এবং মোটর টেস্টিং করেছি। সুযোগমতো তাকে অক্সিজেন দিয়েছি। আমার সাথে ছিলো ডাঃ জিতু মণ্ডল। সে স্যালাইন ব্যাগ ও কিছু IV ফ্লুইডস দিয়েছে।
তারপরেও শঙ্করের অবস্থা ধীরে ধীরে ডিটিরিওরেট হচ্ছিলো। তার রেসপায়ারেশন বার বার দুর্বল হয়ে আসছিলো। আমরা একটু হাইড্রোকরটিসন দিয়েছিলাম। আবার একটু এট্রোপিন দিয়েছিলাম।

তারপরেও তার অবস্থা ডিটিরিওরেট হচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত আমরা শঙ্করকে বাঁচাতে পারিনি। সে মরে গেলো তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই। তবে আমার মনে আছে, সেটা ছিলো ডিসেম্বরের শেষের দিকে।

কোন শিক্ষা পাওয়া গেলোঃ

এই ঘটনা থেকে আমরা অনেক