সীতা সোরেন




বুড়ো সলিতে শুকনো দানার নিচে সরষের বীজগুলির কচুকাচু শব্দে কি এক অদ্ভুত সুরের সৃষ্টি হচ্ছিল! কানে যেমনই সেই শব্দ পড়ল, তেমনিই রান্নাঘরের বারান্দায় বসে থাকা মেয়েটির একটু হাসি ফুটে উঠল। মনে হচ্ছিল, যেন সেই বীজগুলিই তাকে হাসানোর কাজ করছে।
মেয়েটির নাম সীতা সোরেন। ওর বাবা একজন কৃষক। তবে কৃষক হলেও সীতার বাবার বিদ্যের ভালোই ঘাটতি ছিল। তবু ও কিন্তু অক্ষর চেনে। ব্যবসাও করে। অল্প কিছু সরষে, ধান, ভুট্টা আর বাদাম ও গুছিয়ে বেঁধে অষ্টাদশ কিলোমিটার দূরে শহরের হাটে নিয়ে যায়। আর সেই সব বিক্রি করে কিছু টাকা নিয়ে আসে। মাঝেমাঝেই দেখা দেয় ঘরে নতুন কাপড়ের বান্ডিল। কখনও হয়তো সেটা সীতার জন্য, কখনও মা-র জন্য। তবু ওর বাবা কিন্তু চিঠি লিখতে বা পড়তে পারে না।
একদিন হাট থেকে বাবা এনে দিয়েছিল একখানা রেশনকার্ড। লেখা ছিল, সীতার নাম। সীতা শুধু অক্ষর চেনে তাই রেশনকার্ডের উপর লেখা নামটা চিনতে পেরেছিল। আরও কিছু লেখা ছিল, তা সে বুঝতে পারেনি। বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, এগুলো কী লেখা?’
বাবা কিছুক্ষণ রেশনকার্ডটা দেখল। তারপর বলল, ‘লেখা আছে, তুই মাসে একবার পনেরো কেজি চাল পাবি।’
‘কেন?’
‘কারণ, তুই সরকারের একটা মেম্বার।’
‘আচ্ছা, তাহলে তুমিও তো মেম্বার?’
‘ওগুলোতো তোর নাম আছে, আমার নাম নাই।’
সীতা রেশনকার্ডটা নিয়ে চুপচাপ খাটের উপর বসে পড়ল। ও এখন ঠিক বুঝতে পারছে না, ওটা আসলে ব্যাপারটা কী। শুধু এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে, এই কার্ডটা থাকলে ও মাসে একবার পনেরো কেজি চাল পাবে।
তাও কি কম পাবে! চাল পেলেই তো মা ভাত রান্না করবে। আর ভাত খেতে ওরা সবাই ভালোবাসে। সীতা তার দিদির সাথে পরদিনই আস্ত রেশনকার্ডটা নিয়ে রেশন দোকানে গেল। সেখানে ভিড় ছিল। অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। সীতা আর দিদিও গিয়ে লাইনে দাঁড়াল।
একটু পরেই একজন লোক বেরিয়ে এসে সবার সামনে বলল, ‘আজ থেকে রেশনকার্ড দেখাতে হবে। আর ওই যে কার্ডে যে নামটা লেখা, সেই লোকটাই এসে রেশন নিতে পারবে। তা না হলে রেশন নেওয়া যাবে না।’
সীতা দিদিকে বলল, ‘দেখিস, এ তো তোর নাম না।’
‘কী আর করব। তোর নাম আছে বলে তোকে নিয়েই এসেছি। তাড়াতাড়ি নিয়ে যা।’
দিদির কথা শুনে সীতা আর দ্বিধা করল না। সে রেশনকার্ড নিয়ে এগিয়ে গেল। ক্লার্ক আরেকবার রেশনকার্ড চেক করে বলল, ‘পনেরো কেজি চাল।’
‘হ্যাঁ, দিন।’
ক্লার্ক দোকানের ভিতরে গিয়ে চালের বস্তা নিয়ে এলেন। তারপর তিনি সেই চাল দিয়ে একটা বস্তা ভরে দিলেন। আর বললেন, ‘এবার থেকে মাসে একবার এসে নিয়ে যাও।’
সীতা চালের বস্তাটা নিয়ে দিদির হাতে দিল। দিদি বস্তাটা মাথায় তুলে নিয়ে বলল, ‘চল, বাড়ি যাওয়া যাক।’
ঘরে এসে চালের বস্তাটা নিজের খাটের নিচে রেখে দিল সীতা। তারপর মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মা তখন মাছ কাটছিলেন। সীতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
‘মা, আমি রেশন নিয়ে এসেছি।’
‘রেশন?’
‘হ্যাঁ, মা। এই দেখো।’
সীতা রেশনকার্ডটা মায়ের হাতে দিল। মা সেটা নিয়ে দেখল। তারপর বলল, ‘ওরে, এ তো সরকারি কার্ড। এটা দিয়ে তুই প্রতি মাসে একবার চাল পাবি।’
‘হ্যাঁ, মা।’
মা রেশনকার্ডটা আবার সীতার হাতে দিল। তারপর বলল, ‘এটা তুই ভালো করে রেখে দিস। মাস শেষে নিয়ে যাবি আর চাল নিয়ে আসবি।’
‘আচ্ছা, মা।’
সেই দিন থেকে সীতা নিজের রেশনকার্ডটা খুব যত্ন করে রাখে। তাদের বাড়িতে এখন প্রতি মাসে দু’টো করে বস্তা চাল আসে। একটু আগে তো মাত্র একটাই বস্তা আসত। এখন ওরা সবাই মনের সুখে ভাত খায়। আর তার জন্য ওদের ধন্যবাদ জানাতে হয় সীতাকেই। কারণ, ও যদি না থাকত তাহলে ওদের কিছুই মিলত না।
এখন সীতা প্রতি মাসে হাটে যায়। হাটের মোড়ে একটা বইয়ের দোকান আছে। সেখান থেকে ও একটা বই কেনে। আস্ত একটা বই! দোকানদারের কাছে থেকে সীতা বইটা পড়তে শেখে। সেই বইয়ে লেখা সব অক্ষর ও চিনতে পারে। এখন কেউ যদি তার রেশনকার্ডটা দেখতে চায়, তাহলে ও সেই কার্ডটা পড়ে, ‘সীতা সোরেন, গ্রাম : রান্নাগড়, রাজ্য : ঝাড়খণ্ড, পিন : ৮৩৫১০৭।’