সামান্থার পিতা
একটি মেয়ের চোখে নিজের আব্বার আদর
বড় হওয়া মানেই কি ছেলেবেলা ভুলতে শেখা? পড়াশোনা আর কাজের ভিড়ে ছোটবেলার হাজারো মধুর স্মৃতি আজ অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। তারই মাঝে কিছু স্মৃতি খুব পরিষ্কার মনে আছে। যেমন- মাঝ রাতে দুষ্টুমি করার পর অন্ধকারে আব্বার হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটা। আর খুব ছোট বয়স থেকেই স্কুলে বাসে যাতায়াত করতাম বলে কখনো সাইকেল চালাতে শিখিনি। তাই আব্বা স্কুলে যেতে হলে সাইকেলে করে নিয়ে যাবেন, এই নিয়ে সারা দিন অপেক্ষায় থাকতাম।
আমার মনে হয়, কারোর জীবনে দুজনের আদর খুব বেশি জরুরি। একজন হচ্ছে মা, আর আরেকজন হচ্ছে আব্বা। ছোটবেলা থেকেই আমার আব্বার কাছ থেকে এতটাই ভালোবাসা পেয়েছি যে তার বাইরে আর কোনো ভালোবাসার কথা ভাবতে পারি না। আমার আব্বার আদরের কোনো বিকল্প নেই।
স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত আব্বা আমাকে তার সাইকেলের হ্যান্ডেলে করে নিয়ে গেছেন। সময়ের সাথে সাথে সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে বসার সিটে বসে আব্বার পিঠে হাত রেখে যাতায়াত করতাম। হঠাৎ একদিন আব্বা বললেন, আমাদের মেয়ে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। আর আমি তাকে নিয়ে সাইকেল চালাতে পারবো না। আমি নিজে সাইকেল চালাতে পারি কি না সেটাও আব্বাই শিখিয়েছেন।
আব্বার বরাবরই শখ ছিল ঘুরতে যাওয়ার। আমি ছোট বেলায় অনেকবার আব্বার সাথে ঘুরতে গেছি। ছুটির দিনে আব্বা কখনো ট্রেনে, কখনো বাসে করে আমাকে নিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। যদিও তখন আব্বার বেশি টাকা ছিল না। তবুও তিনি আমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে বরাবরই আগ্রহী ছিলেন। তাকে কখনো বলতে হয়নি আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে।
এখনো মনে পড়ে একটি স্মৃতি। যখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, তখন আব্বা আমাকে নিয়ে চট্টগ্রাম ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য ট্রেনে করে রাতে রওনা দিয়েছিলাম। ট্রেনের ভেতর একটা ছোট খাট। আমি গভীর রাত পর্যন্ত আব্বার কোলে বসে গল্প শুনছিলাম। এরপর আব্বার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি আর আব্বা ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছেন।
আব্বার সাথে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে প্রচুর শিক্ষা পেয়েছি। নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিল। একসাথে ঘুরতে গিয়ে আব্বা আমাকে জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। কিভাবে কথা বলতে হবে, কার সাথে কীভাবে মেশতে হবে, বড়দের মূল্য দিতে হবে, কিভাবে খেতে হবে, এমনকি সুন্দর হাসতে হবেও আব্বা শিখিয়েছেন।
যেহেতু আমার আব্বা ছিলেন একজন শিক্ষক, তাই পড়াশোনা নিয়ে তিনি ছিলেন খুব কড়া। পড়া নিয়ে কোনো ব্যাপারেই তিনি ছাড় দিতেন না। তবে পড়াশোনার বাইরে যেকোনো কাজ করতে দিতেন। ঘুরতে যাওয়া, খেলাধুলা, গান করা এসব কিছু করতে উৎসাহ দিতেন। আমার আব্বাকে কখনো কুরআন ছাড়া দেখিনি। জীবনের শুরু থেকেই নিয়ম করে নামাজ পড়েন। আমাকেও নামাজ পড়তে শিখিয়েছেন। আব্বার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছি।
ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষকে খুব বেশি বিশ্বাস করতাম। যে কেউ যা বলতেন তাই বিশ্বাস করে ফেলতাম। কিন্তু আব্বা আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে মানুষকে বিচার করতে হবে। সবাইকে বিশ্বাস করা যায় না। নিজের জ্ঞানে বিচার করে তবেই কাউকে বিশ্বাস করতে হবে।
আব্বা শিখিয়েছেন সত্য বলতে হয়, সততা মেনে চলতে হয়। কাউকে কখনো অসম্মান করা যাবে না। নিজের সম্মান নিজের কাছে রাখতে হবে। কাউকে অসম্মান করলে সেই সম্মান আর ফিরে পাওয়া যায় না।
এতো গুণের মানুষ পৃথিবীতে কমই আছে। জীবনে আব্বার মতো একজন মানুষ পাওয়া আমার সৌভাগ্য। আল্লাহ যেন আব্বাকে সুস্থ, সুন্দর জীবন দান করেন। আল্লাহ যেন এবং আমাদের মধ্যের দূরত্ব কখনো না বাড়ায়।