রাজনগরের এক পুরনো ভবনের সামনে প্রতিদিনই ভিড় জমানো যায়। সেই ভিড়ের মধ্যে যারা আসেন না, তাদের একটা বড় অংশই আসেন কারণ, সেখানে বসে থাকেন রামু ভিখারি। একটা সাদা লুঙ্গি, ফর্সা জামা, মাথায় সাদা টুপি। হাঁটু পর্যন্ত আসা জটা, রামু কখন সেই হাঁটু ঘাড়ে নিয়ে ঘুরেছেন, মনে করতে পারেন না। আজকের দিনেই হয়তো ১৫০ বছর ভরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেই একই জায়গায়।
এত কি হয়ে গেল জীবনে! শান্তিপ্রিয় এ ভিখারির জীবন কতো ঝড় উঠে গেল, তা ভাবলেই মনে হয় অসীম! কোনোদিন মনে পড়ে ঠাকুরগাঁওয়ের সেই বাড়ি, সবুজ মাঠ, ডোবা আর তাতে ভাসানো কতো ফুল! ভাইয়েরা, বোনেরা, বাবা-মা সব মিলিয়ে একটা বড় পরিবার। মনে পড়ে সেই মিঠে দুধ আর রুটি। মনে পড়ে কতো ভালো ছিল জীবনটা!
তারপর যত বয়স বাড়লো, জীবন যেন ঘুরে দাঁড়ালো। সংসারের দায়িত্ব, দুঃখ-দুর্দশা, হাসি-আনন্দ সব মিলিয়ে যখন জীবনকে অতিষ্ট করে ফেললো, তখন হয়তো সেই শান্তিপ্রিয় জীবনটা দূরে সরে গেল। তারপর এলো রাজনগর শহর। শুরু হলো ভিক্ষার জীবন।
প্রতিদিন সকালে বের হয়ে রামু যান শহরের বিভিন্ন সড়কে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন কয়েক ঘণ্টা। কখনো দাঁড়িয়ে কখনো হাঁটতে হাঁটতে ভিক্ষা করেন। লোকে তাঁকে দেন কিছু টাকা বা কখনোবা খাবার। দিনের শেষে সেগুলো জমিয়ে নিয়ে আসেন রাতের আশ্রয়ের জন্য।
রাতে রামু ঘুমোতে যান রাজনগরের একটি মন্দিরের বারান্দায়। সেখানে তিনি একা নন। আরও অনেক ভিখারি রয়েছেন তার সঙ্গে। তারা সবাই একসঙ্গে রান্না করেন, একসঙ্গে খান এবং একসঙ্গে ঘুমান।
রামু ভিখারিদের সঙ্গে থাকতে খুবই সুখী। তারা তার পরিবারের মতো। তারা তাকে ভালবাসে এবং যত্ন নেয়। রামুও তাদের ভালোবাসেন এবং যত্ন নেন।
একদিন সকালে রামু ভিক্ষা করতে বের হন। তিনি একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, যখন তিনি একটা কুকুরকে দেখতে পেলেন। কুকুরটি ছিল খুবই ক্ষুধার্ত এবং দুর্বল। রামু কুকুরটিকে কিছু খাবার দিলেন এবং তার সাথে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন।
রামু কুকুরটিকে নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি তাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন এবং তাকে কিছু খাবার দিলেন। কুকুরটি খুবই খুশি হয়েছিল এবং রামুর পাশে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
রামু কুকুরটিকে "বন্ধু" নাম দিলেন। বন্ধু রামুর সর্বোত্তম বন্ধু হয়ে উঠল। তারা সর্বদা একসঙ্গে থাকত, এবং রামু বন্ধুর খুবই যত্ন নিতেন।
একদিন, রামু এবং বন্ধু রাজনগরের একটি পার্কে বেড়াতে গিয়েছিল। তারা একটি কুকুরের লড়াই দেখতে পেল। কুকুরগুলো খুবই লড়াই করছিল এবং দর্শকরা তাদের উৎসাহ দিচ্ছিল।
রামু কুকুরের লড়াই দেখতে সহ্য করতে পারলেন না। তিনি দর্শকদের কাছে গেলেন এবং তাদের থামতে বললেন। দর্শকরা রামুর কথা শুনল না, এবং কুকুরের লড়াই চলতে থাকল।
রামু দর্শকদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি পার্ক থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি খুবই দুঃখিত এবং হতাশ হয়েছিলেন।
রামু হাঁটতে হাঁটতে রাজনগরের একটি কুড়েঘরের কাছে পৌঁছে গেলেন। তিনি কুড়েঘরের দিকে তাকালেন এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
"আমার জীবনটা কি এমনই?" তিনি নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন। "আমি কি সবসময় এভাবেই থাকব?"
রামু একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আর ভিখারি হবেন না। তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াবেন।
রামু কুড়েঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানের সামনে পৌঁছে গেলেন। দোকানটিতে কাপড় বিক্রি হচ্ছিল।
রামু দোকানের ভিতরে গেলেন। তিনি একটা সাদা শার্ট এবং একটা কালো প্যান্ট বেছে নিলেন। তিনি কাপড়গুলো পরলেন এবং আয়নার দিকে তাকালেন।
আয়নার মধ্যে তিনি একজন নতুন মানুষকে দেখলেন। তিনি আর সেই ভিখারি নন। তিনি একজন নতুন মানুষ, একজন নতুন সূচনার সাথে।
রামু দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রাস্তায় হাঁটতে লাগলেন। তিনি জানতেন যে তার জীবনটা আবার শুরু হয়েছে।