IPS অফিসার মনোজ কুমার শর্মা




ওনাকে কিছুটা আবেগপ্রবণ এবং সংবেদনশীল পুলিশ কর্মকর্তা বলা যায়। দেশের নিরাপত্তারক্ষীদের ক্রাইমের সঙ্গে লড়তে দেখেছি আমরা, কখনো কখনো নিজের জীবন বাজি রেখেও। কিন্তু এই ‘পুলিশওলা’র মনে আবেগ আছে, ভাব আছে। এই আবেগই হয়ত তাকে অন্য সকল পুলিশ কর্মকর্তাদের থেকে আলাদা করে দেয়।
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার এক ছোট্ট গ্রামে জন্ম। পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার কথা আগে কখনোই মনে হয়নি। পিরোজপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্কুলজীবন শেষ করে কলকাতায় চলে এসেছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য।
এক কলেজে ইতিহাস পড়ছিলেন। কিন্তু মৃত্যু সবকিছুই পালটে দিল। প্রথম বর্ষে মাত্র সাত দিন বাকী থাকতেই ওনার বাবা মারা গেলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন ওনার বাবা। বাবার অকাল মৃত্যু ওনার জীবনে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে এল। তাই পড়াশোনা ছেড়ে ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করলেন।
ওই সময় প্রত্যেকদিন কাজ করতে করতে ওনার মনে হত, কিছু একটা ভালো করতে চাই। উনি বুঝতে পারলেন, কিছু একটা না করে উপায় নেই। তাই বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করেন।
এরপর আয়কর আধিকারিক হিসেবে কাজের সন্ধান শুরু করেন। কিন্তু কয়েকটা চেষ্টা সত্তেও সফল হতে পারলেন না। এরপর ওনার মনে হল, প্রথমে একটা চাকরি করা উচিত। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা চাকরি পান। কাজটা ছিল বহুমুখী। একটা কাজ শেষ হতে না হতেই আর একটা কাজের বোঝা এসে পড়ত ওনার ওপর। কাজের চাপ এতটাই বেশি ছিল যে, প্রায় প্রতিদিনই ওনার ঘুম ভাঙত সকাল পাঁচটা নাগাদ। কিন্তু এই চাকরি করে কিছু দিন পরেই একদিন ওনার মনে হল, পুলিশের কাজই তাঁর জন্য সবচেয়ে ভালো।
এরপর শুরু হল UPSC পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। এক প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়াটা কতটা কঠিন, তা না জানলেও ওনার মনে একটাই বিশ্বাস ছিল, প্রচেষ্টা করে গেলে অবশ্যই সফলতা আসবে। একাগ্র চিত্তে পড়াশোনা শুরু করলেন। প্রায় সারাদিনই নিজের ঘরে বসে পড়তেন।
এক বছরের প্রস্তুতির পর পরীক্ষা দিলেন। এবং তাঁর অধ্যবসায় আর কঠোর পরিশ্রম ফল দিল। প্রথম চেষ্টাতেই WBCS পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন এবং পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশ হিসেবে নিয়োগ পেলেন।
ওনার কর্মজীবন শুরু হল হুগলীর চুঁচুড়া সাবডিভিশনে। প্রথম পোস্টিংটা ছিল বিশেষ চ্যালেঞ্জিং। কারণ, চুঁচুড়া সাবডিভিশনটা ছিল ওখানকার সবচেয়ে বড় এবং জটিল সাবডিভিশনগুলির মধ্যে একটি। এক দিকে অবৈধ চাল কারখানা, তোলাবাজি, অস্ত্র চোরাচালান, অন্য দিকে দ্বন্দ্বমূলক রাজনৈতিক আবহ। কিন্তু ওনার কঠোর পরিশ্রম আর আন্তরিকতা সবটাই পালটে দিল।
একবার পুলিশের একটি গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা গেল, চুঁচুড়ার ঘটনার সঙ্গে কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জড়িত। তখন অনেকেই বললেন, ওঁদের গ্রেফতার করলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঝামেলা বাড়বে। কিন্তু ওনি কারও কথাই শুনলেন না। আইনই সবার ওপর সমান প্রযোজ্য।
এর পরে ওনাকে পাঠানো হল পশ্চিম বর্ধমান জেলার গলসি থানায়। দিন-দুপুর-রাত, সাতদিন সাত রাতের তোপ দাগলেন। এক একটা করে অবৈধ চাল কারখানা উদ্ধার করলেন। অস্ত্র জব্দ হল। ডনারের ফাঁদে পড়ল একের পর এক স্থানীয় গুণ্ডা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে গ্রামে গ্রামে ঘুরে জানতে চাইলেন গ্রামবাসীদের সমস্যাগুলির কথা। তাঁর ব্যক্তিত্ব, আচরণ আর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে গলসি ও তার আশপাশের এলাকার মানুষ।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ওনাকে। এক পদ সামনের দিকে, এক পদ উপরে তাকিয়েই সামনে এগিয়েছেন। হুগলি গ্রামীণ জেলার পুলিশ সুপার, কলকাতা পুলিশের লেক থানার আধিকারিক-ইন-চার্জ, কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (দক্ষিণ) এবং বর্তমানে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর কর্মজীবনের এই গতিশীলতা অনুপ্রাণিত করবে অনেককেই।
পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতি আমাদের অনেক রকম অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু মনোজ কুমার শর্মার মতো একজন পুলিশ অফিসারের মতো নিবেদিত প্রাণ পুলিশকর্মীরা আমাদের আশা জাগিয়ে রাখেন। ওনাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানানোর জন্য এটুকুই যথেষ্ট নয়। দরকার তাঁদের জন্য সঠিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। তাঁদের সাহস ও নিবেদিতপ্রাণতায় উৎসাহ দান করা। তাঁদের জন্য শুধুমাত্র সুবিধে বাড়িয়ে দিলেই হবে না। প্রয়োজন আবেগীয়ভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো।
সবশেষ